সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫

আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে নাগরিক মহলের প্রশ্ন

আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে নাগরিক মহলের প্রশ্ন

ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রকাশ্য দিবালোকে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। দায়িত্ব নেওয়ার এগারো মাস পার হলেও দেশে মব সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ইত্যাদি অপরাধের লাগাতার ঘটনায় জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে।

মিটফোর্ডের হত্যার ঘটনা ছাড়াও খুলনায় যুবদল নেতাকে হত্যার পর তার রগ কেটে ফেলা, চাঁদপুরে মসজিদে ইমামকে চাপাতি দিয়ে কোপানোসহ নানা সহিংস ঘটনা দেশব্যাপী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এর আগে মাদারীপুরে মসজিদের ভেতরে আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও সাড়া ফেলেছিল।

এই ধরনের সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে সরকার বা পুলিশ কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না—এমন অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। অনেকে মনে করেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবই পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে। এমনকি কিছু রাজনৈতিক দল অভিযোগ করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থির রেখে নির্বাচন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘মব তৈরি করে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে, যার পেছনে সরকারের কোনো প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে’। তার ভাষায়, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চালায় সরকার, তাহলে তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন’।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের পদক্ষেপে দৃশ্যমান কোনো কঠোরতা দেখা যায়নি। শুরুর দিকেই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ না নেওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সচিবালয়ে জানান, দেশে খুন, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন ও মাদকসহ অপরাধ বাড়ায় আজ রোববার থেকেই 'চিরুনি অভিযান' শুরু করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী যেকোনো কার্যক্রম সরকার কঠোর হাতে দমন করবে’।

গত ছয় মাসে মব সন্ত্রাস অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় সামাজিক মাধ্যমে ঘোষণা দিয়েও প্রকাশ্যে হামলা চালানো হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে ১৪১টি মব ঘটনায় ৮৩ জন মারা গেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ৩৩০টি, যার মধ্যে ৬৬টি ছিল দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ২২টি ধর্ষণের পর হত্যা। একই সময়ে ৮৯ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৪৫ জন ঢাকায়।

রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৪৪ জন। বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে ২৬ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন ১৪৭৭ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছেন ১৫ জন।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে রাজনৈতিক সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সংগঠনটি জানায়, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাসহ সামাজিক অপরাধ জনমনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।

বিএনপির ছাত্রদল অভিযোগ করেছে, ‘গোপন তৎপরতায় অভ্যস্ত একটি সংগঠন মব সৃষ্টির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটাচ্ছে’। যুবদলের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম বলেন, ‘নির্বাচন বিলম্বিত করতেই সরকার প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করেছে’।

অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপিসহ আরও কিছু দল বিএনপির কর্মীদেরই নিয়ন্ত্রণহীন আচরণকে দায়ী করছে। শুক্রবার রাতে তাদের মিছিল থেকে তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও স্লোগান দেওয়া হয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রায় চার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছি। আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা সরকারের দায়িত্ব’।

পুলিশের সাবেক আইজিপি এম নূরুল হুদা বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক শৈথিল্য দেখানো হয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে অনেকেই মনে করছেন, অন্যায় করলে শাস্তি নেই’।

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘মব তৈরি করে খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখল অব্যাহত রয়েছে। সরকারের দিক থেকে দৃশ্যমান কঠোর পদক্ষেপ না থাকায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। আইন প্রয়োগে শৈথিল্য মানেই আইনের শাসনে কুঠারাঘাত’।

তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের নামে এসব অপরাধকে হালকা করে দেখা বিপজ্জনক। সামাজিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোকেও সক্রিয় হতে হবে, না হলে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হবে’।

সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘মব জাস্টিস সরকার বরদাশত করে না। যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্ততা নেই। অপরাধীদের কাউকে ছাড়া হয়নি’।


সূত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

সম্পাদক : অপূর্ব আহমেদ