জুলাই অভ্যুত্থান দিবসে কক্সবাজারে অবকাশযাপন করায় শোকজ করা হয়েছিল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণ) হাসনাত আবদুল্লাহকে। এই নোটিশের লিখিত জবাব দিয়েছেন তিনি। জবাবে তিনি জানান, দলের উচিত ছিল গোয়েন্দা সংস্থা ও অসৎ মিডিয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা নেওয়া। তার পরিবর্তে এমন ভাষায় আমাদের বিরুদ্ধে শোকজ প্রকাশ করেছে। যা মিথ্যা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে উসকে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) কক্সবাজারকাণ্ডে শোকজ নোটিশের জবাবে এমন ক্ষোভ উগরে দেন হাসনাত আবদুল্লাহ। ফেসবুকে নিজের আইডিতে শোকজের জবাবের বিষয়টি শেয়ারও করেন তিনি।
শোকজের জবাব সম্বলিত ফেসবুক পোস্টটি আরটিভি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানুষ জীবন দিয়েছিল নতুন বাংলাদেশের জন্য। এমন একটি রাষ্ট্র গঠনের আশায়, যেখানে কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না এবং প্রতিটি নাগরিক মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবেন। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যেই এই সরকার গঠিত হয়েছিল। সরকারের উচিত ছিল এমন একটি ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা, যা সেই মানুষগুলোর আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করবে।
কিন্তু আমি এবং অনেকেই ব্যথিত হই, যখন দেখি যে এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের সময় সেই মানুষদের কথা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে, যারা অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। শহীদ পরিবার, আহত এবং নেতৃত্বদানকারীদের অনেকেই মতামত প্রদানের সুযোগ পাননি, এমনকি অন্তর্ভুক্তির ন্যূনতম সম্মানটুকুও পাননি।
ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়ায় এমন কিছু উপাদান দেখি, যা অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন, ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে সংবিধান সংস্কারের জন্য জনগণ পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপর দায়িত্ব অর্পণের অভিপ্রায় প্রকাশ করেছে। এই দাবিটি অসত্য এবং সংবিধানে মৌলিক পরিবর্তন আনার পথে একটি বড় অন্তরায়। আমরা শুরু থেকেই দাবি করে আসছি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে, যা রাষ্ট্রের কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনবে এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ঘটাবে।
উপরন্তু, ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় জানতে পারি যে আমাদের আন্দোলনের আহত এবং নেতৃত্বদানকারী অনেক ভাইবোনকে এই অনুষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা আমার কাছে শুধু রাজনৈতিক নয়, নৈতিক ব্যর্থতা বলেই মনে হয়েছে। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। যেখানে ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনকে, শহীদ এবং আহতদের পরিবর্তে কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা এবং মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, সেখানে উপস্থিত থাকার কোনও ইচ্ছা বা প্রয়োজন আমি বোধ করিনি।
কাজেই, এর পরদিন ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। উদ্দেশ্য ছিল এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে পূর্বে গৃহীত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বোঝার চেষ্টা করা এবং পরবর্তী করণীয় নিয়ে চিন্তা করা। একইসাথে এটি ছিলো একটা অসম্পূর্ণ জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রতি আমার নীরব প্রতিবাদ।
ফলস্বরূপ, ৪ আগস্ট রাতে প্রথমে আমি আহ্বায়ক জনাব নাহিদ ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি। তাকে না পেয়ে পরবর্তীতে দলের মুখ্য সমন্বয়ক জনাব নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারীকে অবহিত করি যে আমি আমার স্কুলবন্ধুদের সঙ্গে দুই দিনের জন্য ভ্রমণে যাচ্ছি। যেহেতু তিনি সে সময় অফিসে আহ্বায়ক মহোদয়ের সাথে ছিলেন, আমি তাকে অনুরোধ করি যাতে তিনি আহ্বায়ক মহোদয়কে বিষয়টি জানান। তিনি আমাকে জানান যে তিনি তা করবেন। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর জনাব নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী আমাকে নিশ্চিত করেন যে তিনি আহ্বায়ক মহোদয়কে বিষয়টি জানিয়েছেন এবং আহ্বায়ক মহোদয় এতে সম্মতি প্রদান করেছেন। পরবর্তীতে আমার সঙ্গে জনাব নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী, সস্ত্রীক সারজিস আলম ও তাসনিম জারা- খালেদ সাইফুল্লাহ দম্পতি যুক্ত হন।
কিন্তু এরপর যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। বিমানবন্দর থেকে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের ছবি ও ভিডিও করে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা মিডিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে। কিছু মিডিয়া সেখানে ক্রাইম মুভির মিউজিক জুড়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগসহ সেইসব উপস্থাপন করেছে।
কিছু মিডিয়া ও গোয়েন্দা সংস্থার যোগসাজশে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে অপরাধপ্রবণ এবং সন্দেহজনক হিসেবে উপস্থাপন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। এমনকি গুজব ছড়ানো হয়েছে যে আমরা পিটার হাসের সঙ্গে গোপন বৈঠকে যাচ্ছি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করতে। অথচ তিনি তখন বাংলাদেশেই ছিলেন না।
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এই প্রবণতা, যেখানে কাউকে টার্গেট করে রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে ফেলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। গোয়েন্দা সংস্থা ও মিডিয়ার এই সম্মিলিত ‘ডিমোনাইজেশন’ টেকনিক আজকে আমাদের টার্গেট করেছে। ভবিষ্যতে অন্য যে কাউকে করতে পারে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ব্যাপার হলো, গোয়েন্দা সংস্থা এবং কিছু মিডিয়া এই একই প্যাটার্নে হাসিনার আমলেও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নামে প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করত। নতুন বাংলাদেশেও গোয়েন্দা সংস্থা এবং কিছু মিডিয়ার এই পুরনো অপরাধপ্রবণতা আমাকে একইসাথে অবাক এবং ক্ষুব্ধ করে। এই পুরো ঘটনার সবচেয়ে দুঃখজনক ও নিন্দনীয় দিক ছিল তাসনিম জারার বিরুদ্ধে পরিচালিত নগ্ন ও কুরুচিপূর্ণ স্লাটশেইমিং। শুধুমাত্র একজন নারী হওয়ার কারণে তাসনিম জারাকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার চালানো হয়। কিছু মিডিয়া চক্রান্তমূলকভাবে তাকে কেন্দ্র করে বিভ্রান্তিকর ও আপত্তিকর শিরোনাম প্রকাশ করতে থাকে। গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু গণমাধ্যমের সমন্বিত এই আক্রমণ একটি নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করার সুস্পষ্ট চেষ্টা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ন্যক্কারজনক আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে রাজনীতিতে অংশ নিতে আগ্রহী নারীদের নিরুৎসাহিত করা।
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরেও, গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু গণমাধ্যমের যোগসাজশে একজন নারীর বিরুদ্ধে এমন হীন আক্রমণ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আমি মনে করি আমাদের পার্টির উচিত ছিল এই গোয়েন্দা সংস্থা ও অসৎ মিডিয়ার বিরুদ্ধে দৃঢ় ব্যবস্থা নেওয়া। তার পরিবর্তে পার্টি এমন ভাষায় আমাদের বিরুদ্ধে শোকজ প্রকাশ করেছে, যা মিথ্যা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে উসকে দিয়েছে।
যেকোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে শোকজ করতে হয় গঠনতন্ত্র বা বাই-লজের কোনো নির্দিষ্ট ধারা লঙ্ঘনের কারণে। আমাকে দেওয়া শোকজে এমন কিছুর উল্লেখ নেই, কারণ আমি পার্টির কোনো আইন লঙ্ঘন করিনি। এমন বিধিবহির্ভূত শোকজ দেওয়া এবং অতি উৎসাহী হয়ে তা মিডিয়ায় প্রকাশ করা কতটুকু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক হয়েছে, সে বিষয়ে গভীরভাবে ভাববার অনুরোধ করবো।
আমি এনসিপির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ এবং মনে করি যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও গণতান্ত্রিক সহনশীলতার মাধ্যমেই আমাদের দল রাজনৈতিকভাবে আরও পরিণত হবে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমাকে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যার সুযোগ দেওয়ার জন্য।