শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

মোবাইলে প্রতিদিন লেনদেন ৫ হাজার কোটি টাকা

মোবাইলে প্রতিদিন লেনদেন ৫ হাজার কোটি টাকা

তাৎক্ষণিকভাবে টাকা পাঠানোর সুবিধার পাশাপাশি নতুন নতুন সেবা যোগ হওয়ায় মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) দেশের মানুষের কাছে যেমন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তেমনি বেড়েছে নির্ভরতা। মোবাইল ফোনের সাহায্যে অন্যকে টাকা পাঠানো, মোবাইল রিচার্জ, বিভিন্ন পরিষেবা ও কেনাকাটার বিল পরিশোধ, টিকেট কেনাসহ কত সেবা যে মিলছে, তা এক দমে বলা খুবই কঠিন। সব মিলিয়ে বিকাশ, রকেট, নগদ ও উপায়ের মতো এমএফএস দেশের সাধারণ মানুষকে দিয়েছে আর্থিক লেনদেনে স্বাধীনতা ও স্বাচ্ছন্দ্য। এতে বাড়ছে গ্রাহক ও লেনদেনের অঙ্ক। এসব সেবায় গত মার্চ মাসে লেনদেন হয়েছে এক লাখ ৪৮ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা।

একক মাসের হিসাবে এই লেনদেন সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ এর আগে কখনই এক মাসে এত টাকা লেনদেন হয়নি। এ মাসে দৈনিক গড় লেনদেন হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এর আগে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছিল গত বছরের জুনে, ১ লাখ ৩২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার মোবাইলে আর্থিক লেনদেনের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে লেনদেনের অঙ্ক ছিল এক লাখ ২৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন হয় ১ লাখ ৩০ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে লেনদেনের অঙ্ক ছিল ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা; নভেম্বরে হয়েছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। এভাবেই বাংলাদেশে মোবাইলে আর্থিক সেবা বা এমএফএস ব্যবহার প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

মার্চে এক লাফে লেনদেন প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছে, রোজার কারণে ওই মাসে মোবাইলে লেনদেন বেড়েছে। রমজানে মানুষের বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয়; কেনাকাটাও বেশি করে। সে কারণেই লেনদেনে রেকর্ড হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত অক্টোবর মাসে দেশে মোবাইল ফোনে এক লাখ ২০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা লেনদেন হয়। তার আগের মাস সেপ্টেম্বরে এক লাখ ৮ হাজার ৩৭৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা লেনদেন হয়। আগস্টে লেনদেনের অঙ্ক ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) শেষ চার মাসেই (মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন) মোবাইলে লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছিল। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) প্রথম মাস জুলাইয়ে তা কমে লাখ কোটি টাকার নিচে ৯৮ হাজার ৩০৬ কোটি টাকায় নেমে আসে। এরপরের আট মাসেই (আগস্ট থেকে মার্চ) লাখ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মোবাইলে লেনদেন হয়েছিল ৩২ হাজার ১১৬ কোটি টাকা। প্রতিদিনের গড় লেনদেন ছিল ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সাড়ে পাঁচ বছরের ব্যবধানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন বেড়েছে সাড়ে চার গুণেরও বেশি। লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্রাকহ সংখ্যা। সাড়ে পাঁচ বছর আগে মোট গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৬৮। মার্চে সেই গ্রাহক প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেড়ে ২২ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এভাবেই ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে মোবাইল ব্যাংকিং।

কেবল টাকা পাঠানোই নয়, দেশের অর্থনীতিতে প্রতি মুহূর্তে গতি সঞ্চার করে চলেছে মোবাইল ব্যাংকিং। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ; বেতন-ভাতা প্রদান; বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ প্রবাসী-আয় বা রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা এখন অন্যতম পছন্দের মাধ্যম। প্রতিদিন নতুন নতুন সেবা যোগ হচ্ছে। এই সেবার হাত ধরেই দেশে আসছে ‘ডিজিটাল ব্যাংক’। দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও ডাক বিভাগের মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান নগদ ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া অন্য অনেক ব্যাংকও ‘ডিজিটাল ব্যাংক’ নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে।

বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের ৩১ মার্চ। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ।

পরবর্তী সময়ে আরও অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায়, শিওর ক্যাশসহ ১৫টি ব্যাংক এ সেবা দিচ্ছে। এর বাইরে ডাক বিভাগের নগদও দিচ্ছে এই সেবা। এখন মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম না। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের লেনদেনে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, টিকেট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ ও অনুদান প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেওয়া যাচ্ছে।

এর ফলে একটি মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে নিজের ব্যাংক হয়ে উঠেছে। এমএফএস লেনদেন বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কামাল কাদীর বলেন, “সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী মোবাইল আর্থিক সেবা দেশের মানুষের দৈনন্দিন আর্থিক লেনদেনকে প্রযুক্তিনির্ভর করে সহজ, নিরাপদ এবং তাৎক্ষণিক করেছে। সামগ্রিক অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার মানের ওপর যার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল ইকোসিস্টেম শক্তিশালী করার মাধ্যমে ক্যাশলেস সমাজ নির্মাণেও এই খাত ভূমিকা রাখবে,” বলেন বিকাশ প্রধান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২২ হাজার ৯১১। কিন্তু দেশে মোবাইলে আর্থিক সেবার (এমএফএস) গ্রাহক এখন প্রায় ২২ কোটি। এর কারণ, একজন গ্রাহক একাধিক এমএফএস হিসাব খুলতে পারেন। খবর সকাল সন্ধ্যা ডটকমের।

সম্পাদক : জোবায়ের আহমেদ নবীন