গ্রাহকের আস্থা অর্জনের পর পরিকল্পিতভাবে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের এবি ব্যাংকের নারী কর্মকর্তা অনামিকা দত্তের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতেন তিনি। এরপর সেই আস্থার সুযোগ নিয়ে অর্থ আত্মসাতের কৌশল প্রয়োগ করতেন।
নগরের সদরঘাট থানার নালাপাড়া এলাকার বাসিন্দা শিবু দত্তের মেয়ে অনামিকা দত্ত সবশেষ গ্রাহকের আরও ১০ লাখ টাকা আত্মসাত করেন।
এ নিয়ে নগরের কোতোয়ালী থানায় গত ২২ ডিসেম্বর আরও একটি মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী।
অনামিকা দত্ত, এবি ব্যাংকের চট্টগ্রামের জুবলি রোড শাখায় কর্মরত ছিলেন। পুলিশ জানায়, গত ১২ নভেম্বর নগরের কোতোয়ালী থানাধীন নিউ মার্কেট এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকে চাকরির সুবাদে সত্তোরোর্ধ্ব বয়সী দেবীকা চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন অনামিকা দত্ত। একপর্যায়ে তিনি বিভিন্ন দুর্বল ব্যাংকের উদাহরণ দিয়ে দেবীকাকে জানান, এবি ব্যাংকও দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। তাই দ্রুত এফডিআর ভেঙে নেওয়াই নিরাপদ হবে—এমন পরামর্শ দেন তিনি। অনামিকার কথায় বিশ্বাস করে দেবীকা চৌধুরী তাঁর ক্যান্সার আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসার জন্য রাখা এফডিআর ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন।
এ সময় অনামিকা দত্ত তাঁকে জানান, এফডিআর ভাঙতে তিনটি চেক প্রয়োজন হবে। চেকের প্রয়োজনীয়তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে এফডিআর ভাঙতে চেক লাগে।
অনামিকা দত্ত দেবীকা চৌধুরীকে জানান, এফডিআরের টাকা তাঁর অন্য একটি ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হবে। এই অজুহাতে দ্রুত একাধিক কাগজপত্র ও চেকে স্বাক্ষর নেন তিনি। পরে দেখা যায়, দেবীকার পরিবর্তে ওই অর্থ অনামিকা দত্তের নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে।
সিসিটিভি ফুটেজেও এর প্রমাণ রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ অক্টোবর আন্দরকিল্লা শাখা থেকে ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮৫ টাকা এবং গত ৭ অক্টোবর জুবলি রোড শাখা থেকে আরও ১৪ লাখ টাকা অনামিকা দত্তের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এতে মোট আত্মসাৎ করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৮৮৫ টাকা।
অন্যদিকে একই কৌশলে স্বপ্না দে নামের আরেক গ্রাহকের কাছ থেকেও ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এজাহারে বলা হয়েছে, হিসাব খোলার পর এফডিআর করার কথা বলে অনামিকা দত্ত চেক বই ও জমার রশিদের বই নিজের কাছে রেখে দেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ফরম ও চেকে স্বাক্ষর নেন।
পরবর্তীতে ব্যাংক স্টেটমেন্ট যাচাই করে স্বপ্না দে জানতে পারেন, বিভিন্ন সময়ে তাঁর হিসাব থেকে অনামিকা দত্তের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে ১০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে গার্মেন্টস কর্মী স্বপ্না দে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ নভেম্বর অনামিকা দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। অনামিকা দত্তের প্রতারণার ঘটনায় আরও দু’জনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আসাদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে এবি ব্যাংকের এক গ্রাহকের ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এবি ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। কীভাবে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এবং এতে আর কারা জড়িত, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে এবি ব্যাংকের চট্টগ্রাম জোনাল কর্মকর্তা মো. দিদারুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, অনামিকা দত্ত ব্যাংকের স্থায়ী কর্মকর্তা নন। আত্মীয়স্বজনরা লাভের আশায় হয়তো তাঁকে টাকা দিয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত লেনদেনের সঙ্গে ব্যাংকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
তবে ভুক্তভোগী দেবীকা চৌধুরী ও স্বপ্না দে বলেন, অনামিকা দত্ত আমাদের কোনো আত্মীয় নন। ব্যাংকে লেনদেন করতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। তিনি গত তিন-চার বছর ধরে এবি ব্যাংকের চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত ছিলেন। কোথাও উল্লেখ ছিল না যে তিনি চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী বা ব্যাংক তাঁর কর্মকাণ্ডের দায় নেবে না। আমাদের কাছে অনামিকা দত্ত ছিলেন একজন স্বাভাবিক ব্যাংক কর্মকর্তা, যিনি নিয়মিত গ্রাহকদের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতেন।
দেবীকা চৌধুরীর আইনজীবী এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট আলী আকবর সানজিক বাংলানিউজকে বলেন, অনামিকা দত্ত প্রতারণার মাধ্যমে দেবীকা চৌধুরীর টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আসামিপক্ষ বারবার জামিনের আবেদন করলেও আমরা এর বিরোধিতা করেছি। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। ভুক্তভোগীসহ আরও অনেকের কাছ থেকে আত্মসাৎ করা আনুমানিক ৫৭ লাখ টাকা তিনি অনলাইন জুয়ায় হারিয়েছেন বলে অনামিকা দত্ত স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত শিবু দত্ত বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তাঁর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করা হলে আদালত তা মঞ্জুর করেন।
বিশেষ প্রতিনিধি | বাংলাবাজার পত্রিকা.কম























