শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

জমিদার থেকে মরমী কবি

জমিদার থেকে মরমী কবি হাসন রাজা

নামের সঙ্গে যুক্ত ‘রাজা’। উত্তরাধিকার সূত্রে ছিলেন জমিদার। কিন্তু কর্মে ও চিন্তায় ছিলেন আপাদমস্তক এক বাউল। তবে অপরিপক্ব রাজা হাসন ছিলো বেপরোয়া, যৌবনে ভোগ-বিলাসী এক শৌখিন জমিদার। তিনি হাসন রাজা।

গানে গানে প্রেম, বিরহ, জীবনদর্শন, আধ্যাতিকতার কথা বলে গেছেন। গানকে তিনি নিয়েছিলেন সাধনা হিসেবে। বাংলা গানের যে মরমী ধারা, যুগের পর যুগ ধরে সংগীতপিপাসুদের তৃষ্ণা মিটিয়ে চলছে আর জিজ্ঞাসু করে তুলছে, সেই ধারার অন্যতম সাধক পুরুষ হাসন রাজা।


মরমী কবি হাসন রাজাকে নিয়ে লিখেছেন গাজী কাইয়ুমবাংলাবাজার পত্রিকা.কমের পাঠকদের জন্যে তার লেখাটি এখানে তুলে ধরা হলো।

“নিজেকে ‘কিছু নয়’ বলে যাওয়া হাসন রাজা মৃত্যুর ১০০ বছর পরও প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে বাংলার মাটিগন্ধা গান আর শেকড়ের সংস্কৃতিতে। তার লেখা গান আজও ঘুরে বেড়ায় লোকের মুখে মুখে। গীত হয় নানা শিল্পীর কণ্ঠে”

সংক্ষেপে হাসন রাজা: হাসন রাজা একজন মরমী কবি ও দার্শনিক। চির বৈরাগ্যের এই মানুষটির গান ও দর্শনে মিশে আছে বাংলার মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ। মরমি সাধনা আর আঞ্চলিকতার দর্শন চেতনার সঙ্গে সংগীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছেন তিনি। দর্শন চেতনার নিরিখে লালনের পর যে উল্লেখযোগ্য নামটি আসে, তা হাসন রাজার। তিনি সর্ব-মানবিক ধর্মীয় চেতনার এক লোকায়ত ঐক্যসূত্র রচনা করেছেন। তার রচিত গানগুলো শুনলে মনের মাঝে আধ্যাত্মবোধের জন্ম হয়। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। চারি হাত উঁচু দেহ, দীর্ঘভূজ ধারাল নাসিকা, জ্যোতির্ময় পিঙ্গলা চোখ এবং একমাথা কবিচুল পারসিক সুফীকবিদের একখানা চেহারা চোখের সম্মুখে ভাসতো।

জন্মকাল ও শিক্ষা: হাসন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালে ২১ ডিসেম্বর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটে সুরমা নদীর তীরে লক্ষণশ্রী পরগনায় তেঘরিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী। হাসন ছিলেন তার ৩য় পুত্র। তার পিতা তার নাম রাখেন অহিদুর রাজা। এটি ছিলো তার একটি ছদ্মনাম। তার প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রাজা। তিনি নিজে ছিলেন সশিক্ষিত। তখন সিলেটে আরবি ফারসি ভাষার ব্যাপক চর্চা ছিলো। হাসন রাজা নিজেও আরবি খুব ভালো জানতেন। তার বহু দলিলে আরবির স্বাক্ষর পাওয়া যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত একজন মরমী কবি তার সৃষ্টির মহিমায় দার্শনিক বনে গিয়েছেন।

হাসন রাজার সিংহাসন আরোহন: হাসন রাজার পূর্বপুরুষ ছিল হিন্দু। আদি বসবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায়। অযোধ্যা থেকে তারা এসে পড়েন দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি গ্রামে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে হাসন রাজার দাদা বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব (বাবু রায় চৌধুরী) সিলেটে পাড়ি জমান এবং এখানেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। দাদার মৃত্যুর পর তার বাবা মাতৃ এবং পিতৃবংশীয় সব সম্পদের মালিক হন। ১৮৬৯ সালে তার পিতা আলী রাজার মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর তার বড় ভাই ওবায়দুর রাজা মারা যান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে হাসন জমিদারিতে অভিষিক্ত হয়েছিলেন।

ভোগ-বিলাসী হাসন: অপরিপক্ব বয়সে এত সম্পদের মালিক হয়ে হাসন রাজা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগ-বিলাসী এক শৌখিন জমিদার। বর্ষায় বজরা নৌকা সাজিয়ে গান-বাজনায় ঘুরে বেড়াতেন। তিনি রমনীর প্রতি ভোগান্তর ছিলেন। একদিন হাসন রাজা পুকুর ঘাটের পাশ দিয়ে আসার সময় গ্রামের আরেক মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় এবং তার রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজের গলার মালা ছুড়ে দেন আর গেয়ে ওঠেন ‘সোনা বন্দে আমারে দেওয়ানা বানাইল দেওয়ানা বানাইল, মোরে পাগল করিল’। আরেকবার পিয়ারীর প্রেমে পড়েছিলেন হাসন রাজা। পিয়ারী ছিলেন লখনৌ থেকে আসা একজন বাইজি। তিনিও খুব সুন্দরি ছিলেন। এই পিয়ারীর প্রেমে পড়ে হাসন গেয়েছিলেন ‘নেশা লাগিল রে, বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে, হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিল রে’। তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে ছিলেন দিলারামকে। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে তার মা দিলারামকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করেন। এর পরই হাসন রাজা বাইজিবাড়ি আর শরাবে ডুবে থাকতেন।

ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ: লোকমুখে শোনা যায়, মায়ের ভূমিকার পাশাপাশি হাসন রাজার এক আধ্যাত্মিক স্বপ্ন-দর্শন তার জীবনদর্শন আমূল পরিবর্তন করে দেয়। হাসন রাজা যেমন ঘোর বুঝতে পেরে বলেছেন, ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন/ সাধন বিনে নারী সনে হারাইলাম মূলধন’। তেমন বহির্জগৎ-অন্তর্জগৎ মিলিয়ে প্রজারা যেন দেখা পেলো তাদের অন্য এক রাজার। ভোগবিলাস ছেড়ে বেছে নিলেন চাকচিক্যবিহীন উদাসীন জীবন। একদিকে প্রজাদের খোঁজ-খবর রাখা থেকে শুরু করে নিজের বিষয় সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে অনেক স্কুল, ধর্মপ্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপন করা শুরু করলেন। অপরদিকে খোদাভক্তি, বৈরাগ্য, মরমীভাব ধারণ করে তৈরি করতে লাগলেন একেরপর এক কালজয়ী সৃষ্টি। যেখানে জীবনবোধ-গান-নানামুখী দ্যোতনা একাকার হয়ে গেছে।

হাসনের সৃষ্টিকর্ম: তিনি সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন। হাসন রাজা রচিত সব গান উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিছু তার নায়েব কর্মচারীরা সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন, কিছু গান প্রচলিত হয়েছে লোকমুখে, কিছু হারিয়ে গিয়েছে কালের স্রোতে। তার জীবদ্দশায় সিলেটের ইসলামিয়া প্রেস থেকে ১৯০৭ সালে প্রকাশিত হয় ২০৩টি গানের সংকলন ‘হাসন উদাস’। তার পঙ্ক্তিমালা সমৃদ্ধ প্রাচীন পুঁথিসদৃশ বইটির ২য় সংস্করণ বের করেন কবিপুত্র দেওয়ান গণিউর রাজা চৌধুরী। বর্তমানে দুর্লভ বইটির সংকলিত গান সংখ্যা ২০৬।

কবির ইহকাল ত্যাগ: ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর হাসন রাজা মৃত্যুবরণ করেন। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে মায়ের কবরের পাশেই কবরে তিনি শায়িত আছেন। যে কবর মৃত্যুর পূর্বে নিজেই প্রস্তুত করেছিলেন। আর সেই কবরের গায়ে লেখা এপিটাফ– ‘লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ি ভালা নাই আমার, কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার’

সম্পাদক : জোবায়ের আহমেদ