শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

লাশের স্তূপে শোকের মাতম

ভূমিকম্পের দুইদিন পর ধসে পড়া ভবনের নিচ থেকে উদ্ধার করা শিশু- ইন্টারনেট

তীব্র শীতের মধ্যেই তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধসে পড়া হাজারো ভবনের নিচে আটকা পড়াদের জীবিত উদ্ধারে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। আর সারি সারি লাশের স্তূপে চলছে শোকের মাতম। সেই শোক ছেয়ে গেছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক আদেশে এই শোক ঘোষণা ঘোষণা করা হয়।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সামপ্রতিক ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ার নাগরিকদের মৃত্যুতে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে এক দিনের শোক পালন করা হবে। শোক পালনের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। এদিকে সোমবার ভোররাতের ওই ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা এরই মধ্যে ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ধ্বংসযজ্ঞের যে ধরন, তাতে এই সংখ্যা এখনকার কয়েকগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভূমিকম্পে সম্ভবত শিশুই কয়েক হাজার মারা পড়েছে, বলেছেন জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান ১০টি প্রদেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। অন্যদিকে তুরস্কে ভূমিকম্পের প্রায় ৪০ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশি ছাত্র গোলাম সাঈদ রিংকুকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় রাত নয়টায় তাকে উদ্ধার করা হয়। তবে রিংকুর শারীরিক অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছে তুরস্কের আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র। এর আগে সোমবার আরেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান, গোলাম সাঈদ রিংকু তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কয়েক বছর আগে উচ্চশিক্ষা নিতে তুরস্কে যান তিনি। সোমবার ভোরে ভূমিকম্পের পর তার মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। পরিচিতজনরা কেউ তার খোঁজ পাচ্ছিলেন না। পরে গোলাম সাঈদ রিংকুর পরিবার বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করে।

ছেলের নিখোঁজের বিষয়টি দূতাবাসকে জানান বাবা গোলাম রাব্বানি। সোমবারের ওই ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প তুরস্ক ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের হাজার হাজার ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, স্কুল ধসিয়ে দিয়েছে, হাজার হাজার মানুষকে আহত করেছে, অগণিত মানুষ পরিণত হয়েছে উদ্বাস্তুতে। ওই ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা পর কাছাকাছি মাত্রার শক্তিশালী আরেকটি কম্পনও দেশদুটিকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক, বাজে আবহাওয়া, সম্পদ ও ভারী যন্ত্রপাতির স্বল্পতার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছানো ও সেখানে উদ্ধারকাজ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে উদ্ধারকর্মীদের। কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিক সাড়া না পেয়ে অনেক জায়গায় বাসিন্দারা কোনো উপকরণ ছাড়া খালি হাতেই জীবিতদের উদ্ধারে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে মরিয়া হয়ে নেমে পড়েন। বিভিন্ন দাতা সংস্থার কর্মকর্তারা সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন; প্রায় ১২ বছরের যুদ্ধ শেষে দেশটি এমনিতেই চরম মানবেতর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।

তুরস্কে এরদোয়ান ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি প্রদেশকে ‘বিপর্যস্ত এলাকা’ ঘোষণা করে সেখানে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। এর ফলে সরকার পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে ওই প্রদেশগুলোর জন্য আলাদা আইন কার্যকর করতে এবং সেখানকার বাসিন্দাদের বিভিন্ন অধিকার ও স্বাধীনতা স্থগিত বা সীমিত করতে পারবে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সাময়িক সময়ের জন্য রাখতে সরকার পর্যটন হাব আনতালিয়ার হোটেলগুলো খুলে দেবে, বলেছেন এরদোয়ান।

ভূমিকম্পে দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৯৫৭ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে দুর্যোগ বিষয়ক সংস্থা। আহতের সংখ্যা ৩৪ হাজারের বেশি বলে আগেরদিনই জানিয়েছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায়। পশ্চিমের আদানা থেকে পূর্বের দিয়ারবাকির পর্যন্ত ৪৫০ কিলোমিটার এবং উত্তরের মালাতিয়া থেকে দক্ষিণের হাতয় পর্যন্ত ৩০০ কিলোমিটারভুক্ত প্রায় এক কোটি ৩৫ লাখ মানুষ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে তুর্কি কর্তৃপক্ষ। সিরিয়ায় ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে আড়াইশ কিলোমিটার দূরের হামাতেও মৃত্যুর খবর মিলেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসুস বলেছেন, এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে। প্রতিটি মিনিট যাচ্ছে, ঘণ্টা যাচ্ছে, জীবিতদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কমছে। পুরো অঞ্চলজুড়েই উদ্ধারকর্মীরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন, অন্যদিকে মানুষজন ধ্বংসস্তূপের বাইরে এই আশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন যে বন্ধু, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের জীবিত পাওয়া যাবে।  

সিরিয়া সীমান্তবর্তী হাতয়ের রাজধানী আনতাকিয়ায়য় উদ্ধারকারীর সংখ্যা এতই কম যে বাসিন্দারা নিজেরাই ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে নেমে পড়েছেন। তারা হেলমেট, হাতুড়ি, লোহার রড ও দড়ির জন্য আকুতি জানাচ্ছেন।

ভূমিকম্পের ৩২ ঘণ্টা পর ৮ তলা এক ভবন থেকে ৫৪ বছর বয়সি গুলুমসার নামের এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এরপরই এক নারী উদ্ধারকর্মীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন, “উনি (উদ্ধার হওয়া নারী) যেখানে ছিলেন, তার পেছনের ঘরেই আমার বাবা ছিলেন। দয়া করে, তাকেও বাঁচান।” কিন্তু তা হওয়ার নয়। উদ্ধারকর্মীরা পরে তাকে বুঝিয়ে বলেন, সামনের দিক থেকে তারা ওই ঘরে পৌঁছাতে পারবেন না, যেতে হলে তাদের দরকার খননযন্ত্র, যা দিয়ে প্রথমে দেয়াল সরানো যাবে। তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্গত এলাকাগুলোতে ১২ হাজারের বেশি উদ্ধার ও অনুসন্ধানকর্মী কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে আছেন ৯ হাজার সেনা। ৭০টিরও বেশি দেশ তুরস্কে উদ্ধারকারী দল এবং অন্যান্য সহযোগিতা পাঠিয়েছে।  

ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এলডার জেনিভায় সাংবাদিকদের বলেন, তুরস্ক-সিরিয়ায় এবারের ভূমিকম্পে ‘সম্ভবত কয়েক হাজার শিশুও মারা পড়েছে’। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে উত্তরপশ্চিম সিরিয়া ও তুরস্কে অবস্থার করা শরণার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন, বলেছেন তিনি। সিরিয়ায় যে পরিবারগুলোর ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে তাদের জন্য মসজিদ খুলে দেয়া হয়েছে।

সম্পাদক : জোবায়ের আহমেদ