মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪

রাতের অন্ধকারে না, সরকার হবে ভোটের মধ্য দিয়ে: শেখ হাসিনা

রাতের অন্ধকারে না, সরকার হবে ভোটের মধ্য দিয়ে: শেখ হাসিনা

আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে তারিখ রেখেছে নির্বাচন কমিশন, সেই ভোটের মধ্য দিয়েই নতুন সরকার গঠন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনী বিভিন্ন আইন সংস্কার, সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, আমাদের সবসময় লক্ষ্য ছিল জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। ভোটের মধ্য দিয়েই সরকার গঠন হবে; অস্ত্র হাতে না, রাতের অন্ধকারে না। আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’- এ স্লোগান দিয়ে মানুষকে আমরা ভোট নিয়ে সচেতন করি। ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করি। যে ক্ষমতা সেনানিবাসে বন্দি ছিল, সেটা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিই আমরা। শুক্রবার তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

ইসি গঠনে যে কোনো আইন আগে ছিল না, তা নিয়ে ছিল সমালোচনা। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে আকস্মিকভাবেই আইন প্রণয়ন হয়, আর সেই আইনের অধীনে গত বছরের শুরুতে প্রথম নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নেন কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ পাঁচজন। এর বাইরে সংসদীয় আসন সীমানা নির্ধারণে নতুন আইন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন, জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন (সংশোধন) আইন এবারের মেয়াদে প্রণয়ন করেছে সরকার।

টানা তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের উন্নয়নের পরিকল্পনা তৃণমূলের মানুষকে লক্ষ্য রেখেই করা। শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় লোক লাভবান হবে- যা ক্ষমতায় আসলে স্বৈরশাসকরা করতো, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে কিছু এলিট শ্রেণি তৈরি করতো, হাতে সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য, ধন-সম্পদ তুলে দিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করত। আমাদের সেটা ছিল না, আমাদের ছিল জনগণের ক্ষমতার ক্ষমতায়ন; তৃণমূলের মানুষ যাতে ক্ষমতা পায় তা করা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমরা সারা বাংলাদেশে সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছি। মানুষের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। একটা দল টানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর মানুষের বিশ্বাস-আস্থা অর্জন করা কঠিন। আমরা পরিকল্পিতভাবে দেশের উন্নয়ন করেছি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দেশের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সরকার প্রধান। এ ১৪ বছরে বাংলাদেশে বিরাট পরিবর্তন আমরা আনতে পেরেছি। আজকে মানুষকে বিদেশি পুরান কাপড় এনে পরাতে হয় না। দেশের মানুষকে খাদ্যের জন্য হাহাকার করতে হয় না। ফিলিস্তিনে ইসরাইলি হামলার ঘটনায় সরকারের প্রতিবাদ জানানোর কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য হল যারা অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষকে পুড়িয়ে মারে, যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে; সেসব দলের কাছে কোনো আওয়াজই পাচ্ছি না, কিছুই বলছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে অতি বামপন্থি ও অতি ডানপন্থিরা-সব একাকার হয়ে মিলে গেছে। কে যে কার আদর্শ বিচ্যুত হল, সেটাই প্রশ্ন।

অতি বামদের আদর্শ নেই, তারা বলে- এখন আমাদের সরকারকে উৎখাত করতে হবে। আমাদের অপরাধটা কী? আর নির্বাচন বানচাল করতে হবে। তার মানে হল- যারা রাতের অন্ধকারে অস্ত্র হাতে নিয়ে ক্ষমতা দখল করে, তারপর নিজেদের রাজনৈতিক নেতা বানানো, নির্বাচন নামে প্রহসন।

অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের যে ইতিহাস বাংলাদেশের আছে, সেই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান, এরশাদের ক্ষমতা দখলকে উচ্চ আদলত অবৈধ বলে রায় দিয়েছে। তাদের হাতে গড়া দলের কাছ থেকে শুনতে হয় নির্বাচন, বিএনপির আমলে যত নির্বাচন হত মানুষ ভোটেই দিতে পারেনি, ভোট চুরির অপরাধে খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ভোট চুরি করলে এ দেশের মানুষ মেনে নেয় না। আমরা জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তাদের সচেতন করেছি।

বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ-হরতালের মধ্যে সমপ্রতি বিভিন্ন যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার যেসব ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আগুন নিয়ে খেলছে। বিএনপি ও তাদের জোটকে বলব- আগুন নিয়ে খেলা বাংলাদেশের মানুষ কখনো মেনে নেবে না। তারা নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছে, এটা তারা বানচাল করতে পারবে না। বাংলাদেশের নির্বাচন জনগণের অধিকার। জনগণ তার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, যাকে (ভোট) দেবে- তারাই সরকার গঠন করবে। মানুষকে গণতান্ত্রিক ধারা সম্পর্কে সচেতন আমরা করেছি। পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে সরকারে উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন সরকার প্রধান।

তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতির কারণে সরকারি চাকুরিজীবীদের জন্য ৫ শতাংশ বেতন বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে পোশাক শ্রমিকদের জন্য ৫৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে । তার পরেও দেখলাম ১৮-১৯টা কারখানা ভাঙচুর, আন্দোলন। আওয়ামী লীগ ছাড়া যারা ২৯ বছর ক্ষমতায় ছিল, তারা কত শতাংশ বেতন বাড়িয়েছে শ্রমিকদের? বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলে কিছুই বাড়ায়নি; যেটুকু করার আওয়ামী লীগের আমলে হয়েছে।

দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানুষের পাশে থেকে সেবা করেছে উল্লেখ করে দলটির প্রধান শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মানুষের সেবা, অধিকারটা সুনিশ্চিত করেছি বলেই তাদের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করেছি। আজকে সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে- কোন দলের উপর তাদের আস্থা আছে? সেটা আওয়ামী লীগের উপরই আছে। এ আস্থা-বিশ্বাসটা ধরে রেখেই আমাদের এগুতে হবে। আজকে যারা নির্বাচন বানচালের নামে অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছে, এদের কিন্তু ক্ষমা নেই। এগুলো আমরা বরদাশত করব না।

নির্বাচন বানচালের নামে এক দশক আগে প্রায় ৫০০ স্কুল পুড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি নির্বাচনী কর্মকর্তা, বিচারক, আইনজীবীদের ওপর হামলা হয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এরা মানুষকে মানুষ মনে করে না। এখন নিজেরা লুকায় থাকে, আমার কথা হচ্ছে বিএনপির নেতৃত্ব কোথায়? একজনতো এতিমের অর্থ আত্মসাত করে সাজাপ্রাপ্ত; বয়স হয়ে গেছে- অসুস্থ। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তি দেয়ার প্রসঙ্গেও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, আমি খালেদা জিয়াকে বাসায় থাকার অনুমতিটা দিয়েছি, সে স্বাধীনভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে। কোনও সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হয়, তাহলে তাকে কোর্টে যেতে হবে। আমরা বলেছি কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিয়ে অনুমতি নিক। সেটা না করে ওইটা নিয়ে আবার আন্দোলনের চেষ্টা করে। আসলে এরা ইস্যু হিসাবে দেখে। আদৌ যদি চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠাতো, তাহলে বিএনপির পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেয়া হত।

শেখ হাসিনা বলেন, তারেক রহমান লন্ডনে বসে হুকুম দেয়, আর এখানে যারা অগ্নিসন্ত্রাস করে- তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যে দলের নেতাই নেই, মুণ্ডহীন দল, মাথায় নাই; সে নেতা কখনোই আসবে না। আসার ইচ্ছা থাকলে চলে আসতে পারত। তার হুকুমে বাংলাদেশে যারা মানুষের ক্ষতি করে যাচ্ছে, আগুন দিয়ে পোড়াচ্ছে, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে তাদের ক্ষতি করছে; এ দায়িত্বটা তারা নিচ্ছে কেন?

তারা নির্বাচন করতে চায় না, কারণ এটা মুণ্ডহীন একটা দল হয়ে গেছে। কারণ সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া নির্বাচন করতে পারবে না। এ জন্য তারা নির্বাচন চায় না। চায় না বলেই নির্বাচন বানচাল করতে হবে। বানচাল করে তাদের লাভটা কী হবে? বাংলাদেশের মানুষের লাভটা কী হবে? যারা এ ধরনের নেতৃত্বের হুকুমে মানুষের ক্ষতি করে; তারা তো অভিশাপ পাবে, মানুষের অভিশাপ পড়বে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কয়টা মানুষ অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার- তারা তো অভিশাপ দিচ্ছে, তাদের পরিবার দিচ্ছে। কারণ তাদের জীবন-জীবিকা, পোড়া ঘা নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। যারা সাধারণ মানুষকে হত্যার পরিকল্পনা করে, তাদের কেন মানুষ ভোট দেবে- এ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “মানুষ কেন আস্থা রাখবে? মানুষ আস্থা রাখে না। মানুষ তাদের বিশ্বাস করে না। তারা ঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত। নির্বাচন জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এটা তাদের ভোটের অধিকার। সময় এসেছে, নির্বাচন হবে, জনগণ ভোট দেবে। কারণ যদি সাহস থাকে- নির্বাচন করবে, জনগণের ভোট পাওয়ার মতো শক্তি থাকলে তারা ভোট পাবে। জনগণ যাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, সে সরকার গঠন করবে। জনগণের উপর আস্থা রাখতে না পেরে হামলা করছে। দেশবাসীকে বলব- সচেতন থাকতে। প্রত্যেক এলাকায় যেখানে অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়িতে বোমা মারছে বা পোড়াচ্ছে, ওই অঞ্চলে বিএনপি-জামায়াতের কারা করছে, খুঁজে বের করতে হবে। পাহারা দিয়ে অপরাধীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বানও জানান শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, জনগণ প্রতিরোধ করলে এরা সাহস পাবে না। যে পোড়াবে, তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এবার আর কোন ছাড়াছাড়ি নেই।

ভোটে অংশ নিতে সরকার বিরোধীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা অপরাধ করেছেন, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতৃজনগণকে অগ্নিসন্ত্রাসে হত্যা, জানমালের ক্ষতি করেছেন- সেজন্য জাতির কাছে মাফ চেয়ে নির্বাচনে আসেন। সেটাই আমরা চাই। নির্বাচনের দরজা সকলের জন্য উন্মুক্ত। আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করবে বলে জানান শেখ হাসিনা। 

তিনি বলেন, যাদের মনোনয়ন দেয়া হবে, তারাই নির্বাচন করবে। জনগণের ভোট পাব- এই আশা আমার আছে। এ বিশ্বাস জনগণের উপর আছে। তা না হলে ১৪ বছরে যে উন্নতিটা করেছি, আজকে যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ- এটাকে ওরা আগুন দিয়ে ধ্বংস করবে, পোড়াবে। কাজেই পোড়াতে বা ধ্বংস করতে না পারে- সেদিকেও জনগণকে সচেতন থাকতে হবে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কাছে শনিবার সকাল থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম বিক্রি করবে আওয়ামী লীগ। জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে, স্বাধীনভাবে জনগণ ভোট দিতে পারে- সেই পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো চেয়ারম্যান করা হয়েছে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ সাহেবকে। কারণ কো-চেয়ারের অনেক কাজ থাকবে, সারাক্ষণ বসে শুধু লেখালেখি করতে হবে। এছাড়াও আর ১৪টি কমিটি আছে। আমাদের ইশতেহার প্রস্তুত।

তফসিল ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেন, তারা অন্তত এ জ্বালাও-পোড়াওতে ভীত না হয়ে, সাংবিধানিক নিয়ম মেনে সময় মতো নির্বাচন সিডিউল ঘোষণা দিয়েছেন। এখন নির্বাচন যেন যথাসময়ে সুষ্ঠুভাবে হয়, সেজন্য দেশবাসীর সহযোগিতা আমি চাই। দেশবাসীকে বলব- আপানাদের ভোটের অধিকার সুরক্ষিত, নিশ্চিত ও মনমত সরকার গঠন করবার জন্য এ নির্বাচন। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে যারা নির্বাচিত হবে, তারাই সরকার গঠন করবে। গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করতে হবে। পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার কোন সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক ধারার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

সম্পাদক : জোবায়ের আহমেদ নবীন