বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪

স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার হিড়িক

স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার হিড়িক

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতি আসনে গড়ে নৌকার প্রার্থী হতে মনোনয়ন চেয়েছিলেন ১১ জন। নৌকা পেয়েছেন একজন। বাকি ১০ জন এখন কী করবেন, সেই আলোচনা রাজনীতির মাঠে। আর তাতে বেশ জোরেশোরে বাতাস দিচ্ছে বিকল্প প্রার্থী (ডামি) রাখার দলীয় পরামর্শ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আনতে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিদ্রোহী তকমা দেয়া হবে না। এবার নরম সুর আওয়ামী লীগে। তাই নৌকাবঞ্চিত অনেকে লড়বেন নৌকার বিপক্ষে।

‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ যেন নির্বাচিত হতে না পারে’—আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘুরছে। দলীয় প্রতীকের বিপক্ষে প্রার্থী হতে এটিকেই এখন অনুপ্রেরণার জায়গা হিসেবে দেখছেন নৌকাবঞ্চিতরা। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ডজনখানেকের বেশি নেতা।

রোববার গণভবনে নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী সবার সঙ্গে সভা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সভাতেই তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলেন বলে আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্যমতে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর চাপ প্রয়োগ না করতেও নৌকার প্রার্থীদের প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। এরপর সভায় উপস্থিত থাকা অবস্থায়ই নিজের ফেসবুকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন আওয়ামী লীগ নেতা আরিফুর রহমান। তিনি ফরিদপুর-১ আসন থেকে নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান।

আরিফুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াইয়ের অনুমতি দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। কৃতজ্ঞতা। প্রধানমন্ত্রী বললেন, স্বতন্ত্র দাঁড়াতে কোনো অসুবিধা নেই। তৈরি থাকুন ফরিদপুর-১ আসনের জনগণ। আপনারাই শক্তি।’

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে। তারা বলছেন, এবার আগে থেকেই নির্বাচনে না আসার ঘোষণা দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এতে করে মাঠে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তৈরি করতে টানা তিনবার ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের অনেক আসনে প্রার্থী বদলের ইঙ্গিত ছিল। তাই আগে থেকেই নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক জনসংযোগ করেছেন নেতারা। বর্তমান সংসদ সদস্যের বিপক্ষে মনোনয়ন পেতে অর্থ খরচও করেছেন প্রচারে। এ ছাড়া তাদের যারা প্রচারে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের প্রতিও দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এখন স্বতন্ত্র প্রার্থিতার সুযোগ থাকায় তারা ভোটের মাঠে থাকতে চাইছেন। আবার বর্তমান সংসদের ৭১ জন সদস্য নৌকার মনোনয়ন হারিয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ মনে করছেন, নৌকার বিপক্ষে লড়েও জয় পেতে পারেন তারা। তাই তারাও এবার লড়তে পারেন নৌকার বিপক্ষে।

চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য ও বর্তমান সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী নানা ঘটনায় বেশ কয়েকবার বিতর্কের মুখে পড়েন। এবার তার বদলে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করেছেন। তবে মাঠ ছাড়ছেন না সামশুল হক। দলীয় মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়ার কথা ভাবছেন তিনি।

সিলেট-৬ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সারোয়ার হোসেন। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নেত্রীর নির্দেশনায় আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হব ইনশা আল্লাহ।’ ঢাকা-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান মোল্লা। তার পক্ষ হয়ে ফেসবুকে এ ঘোষণা দিয়েছেন তার ভাই ও ডেমরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহুফুজুর রহমান মোল্লা।

টানা ষষ্ঠবারের মতো রাজবাড়ী-১ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী। সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়তে চান রাজবাড়ী সদর উপজেলায় টানা চারবারের চেয়ারম্যান ইমদাদুল হক বিশ্বাস। এজন্য সম্প্রতি তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। 

নৌকার মনোনয়ন চেয়ে পাননি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাহাবুদ্দিন আহমেদ চঞ্চল। লম্বা সময় ধরে মানিকগঞ্জ-২ আসনে নিয়মিত রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি পালন করছেন তিনি। তাঁর বাবা সামসুদ্দিন আহমেদ এখানকার সাবেক সংসদ সদস্য। সাহাবুদ্দিন আহমেদ এবার তাই স্বতন্ত্র হয়ে লড়বেন এখানে। তাঁর বিপক্ষে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম।

যশোর-২ (চৌগাছা-ঝিকরগাছা) আসনে এবার প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়েছেন চিকিৎসক তৌহিদুজ্জামান তুহিন। তিনি আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদের জামাতা। এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনির। তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ বিষয়ে স্থানীয় সবার মতামত জানতে চেয়েছেন। ফরিদপুর-৪ আসনে আবারও নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ। এর আগে তিনি পরপর দুবার নৌকা নিয়ে হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবুর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন) কাছে। বর্তমান সংসদ সদস্য ও যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নিক্সন এবারও নৌকা চেয়ে পাননি। তবে আগের মতোই থাকছেন ভোটের লড়াইয়ে।

রংপুর-৬ আসনে আবারও নৌকা পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। নৌকা না পেয়ে এখান থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। তিনি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ইতিমধ্যেই।

হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে নৌকা চেয়ে পাননি আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন। ইতিমধ্যেই ফেসবুকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সায়েদুল হক সুমন নির্বাচনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে ফেসবুকের একাধিক পোস্টে। চাঁদপুর-৪ আসনে আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক সংসদ সদস্য শামসুল হক ভূঁইয়া। তিনি চাঁদুপর-৩ আসন থেকেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

চাঁদপুর-১ আসনে এবার নৌকা পেয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম মাহমুদ। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম হোসেন। চাঁদপুরের অন্য আসনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে তোড়জোড় চলছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে নৌকা পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মো. শাহজাহান আলম। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়বেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মঈনউদ্দিন মঈন।

নেত্রকোনা-১ (দুর্গাপুর-কলমাকান্দা) আসনে এবার নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন মোশতাক আহমেদ রুহী। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত জালাল উদ্দিন তালুকদারের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ঝুমা তালুকদার। তিনি নৌকার মনোনয়ন চেয়ে পাননি। দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে পদত্যাগ করেছেন জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য।

বিএনপি ছাড়া অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের নির্বাচনে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এবার তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না আওয়ামী লীগ। ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাও চায় মাঠে। তাই নৌকা পেতে ৩ হাজার ৩৫৬টি আবেদন ফরম কেনা নেতাদের কাজে লাগাতে চায় আওয়ামী লীগ। সারা দেশেই তাই নৌকাবঞ্চিত নেতাদের মধ্যে উৎসাহ ছড়িয়ে পড়ছে। প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ৩০ নভেম্বর। এলাকায় এলাকায় ভোটারদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন অনেকেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থন লাগে। ধারণা করা হচ্ছে, অধিকাংশ আসনেই প্রার্থী হবেন বঞ্চিতরা। দেশের বিভিন্ন উপজেলায় চেয়ারম্যানদের পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার হিড়িক পড়েছে। চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে সংসদ নির্বাচনে লড়তে চান তারা।

সোমবার শহীদ ডা. মিলন দিবসে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিদ্রোহীদের বিষয়ে নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, নতুন নতুন সময়ে নতুন নতুন কৌশলও দলকে গ্রহণ করতে হয়। এ সময়ে যে কৌশল দরকার, নেত্রী সে কৌশল ঠিক করেছেন। দলের অবস্থান অনুযায়ী, ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে দলীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন এবং দেন। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা যে গাইডলাইন দিয়েছেন, সেটা অনুসরণ করে প্রার্থী হতে বাধা নেই।

সম্পাদক : জোবায়ের আহমেদ নবীন