ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান, যা মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আত্মিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা দান করেছে। মানবিক সম্পর্কের এই সামগ্রিক বিধানের মধ্যে মেহমানদারি বা অতিথি আপ্যায়ন একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর পবিত্র জীবনচরিত এক্ষেত্রে আমাদের জন্য এক জীবন্ত ও বাস্তবসম্মত আদর্শ। তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ ও প্রতিটি অনুমোদন মেহমান ও মেজবান উভয়ের জন্যই পাথেয়, যা পারস্পরিক সুসম্পর্ক, শ্রদ্ধাবোধ ও সামাজিক সম্প্রীতির এক অমূল্য দলিল।
মেহমানদারির বিধান ও সময়সীমা
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘এক রাত মেহমানদারি করা মুসলিমের কর্তব্য। যার আঙ্গিনায় মেহমান নামে, একদিন মেহমানদারি করা তার উপর ঋণ পরিশোধের সমান।’ (আবু দাউদ: ৩৭৫০) তিনি আরও বলেন, ‘মেহমানদারি তিন দিন, আর সর্বোত্তম মেহমানদারি এক দিন ও এক রাত।’ (সহিহ মুসলিম: ৪৪০৬)
এই সময়সীমা নির্ধারণের মাধ্যমে ইসলাম উভয় পক্ষের অধিকার রক্ষার ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
মেহমানদারির ফজিলত ও পুরস্কার
মেহমান আপ্যায়ন ইসলামে অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, খাদ্য দান করো এবং মানুষ ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় নামাজ আদায় করো; তাহলে নিশ্চয়ই তোমরা শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তিরমিজি: ২৪৮৫)
তিনি আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমভাবে কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেয়, সর্বদা রোজা রাখে এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাজ আদায় করে, সে জান্নাতে বিশেষ প্রাসাদ লাভ করবে।’ (তিরমিজি: ১৯৮৪)
মেহমানদারির আদব ও শিষ্টাচার
ইসলাম মেহমানদারির জন্য কিছু আদব নির্ধারণ করেছে—
মেহমানকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো (বুখারি: ৬১৭৬)
নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করা (বুখারি: ৫১৮৩)
বয়োজ্যেষ্ঠদের অগ্রাধিকার দিয়ে ডান দিক থেকে পরিবেশন শুরু করা (মুসনাদে আবি ইয়ালা)
বিদায়ের সময় দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া (ফাতহুল বারি: ৯/৫২৮)
রাসুলুল্লাহ (স.) নিজ জীবনে এসব আদব বাস্তবায়ন করে আমাদের জন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন।
মেহমানদের অবস্থান সম্পর্কে নবীজির নির্দেশনা
সীমিত আয়ের বাস্তবতায় অনেক সময় মেহমানের দীর্ঘ অবস্থান মেজবানের জন্য কষ্টদায়ক হতে পারে। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) সতর্ক করে বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাইয়ের কাছে অবস্থান করে তাকে পাপে নিপতিত করবে।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! কিভাবে সে তাকে পাপে নিপতিত করবে? তিনি বললেন, সে (মেহমান) তার নিকট (এমন বেশি দিন) থাকবে, অথচ তার (মেজবানের) এমন সম্বল নেই যা দ্বারা সে তার মেহমানদাবি করবে।’ (সহিহ মুসলিম: ৪৪০৬)
অর্থাৎ, অতিথি এমনভাবে অবস্থান করবে না যাতে মেজবান কষ্টে পড়ে।
অতিরিক্ত চাপ নেওয়া বা অপচয় নিষেধ
ইসলাম বাহ্যিক প্রদর্শনী বা বাড়াবাড়িকে নিরুৎসাহিত করেছে। রাসুল (স.) মেহমানদারিতে সাধ্যের বাইরে খরচ করতে নিষেধ করেছেন। সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘যদি না রাসুল (স.) আমাদের নিষেধ করতেন, তবে আমরা অবশ্যই তোমার জন্য কষ্ট স্বীকার করতাম (অর্থাৎ মেহমানদারিতে অহেতুক খরচ করতাম)।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৩৭৭৪)
মেহমানের কর্তব্য ও শিষ্টাচার
ইসলাম যেমন মেজবানের কর্তব্য নির্ধারণ করেছে, তেমনি মেহমানেরও কিছু শিষ্টাচার নির্ধারিত আছে।
মেহমানের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যগুলো হলো-
যেখানে বসানো হয়, সেখানে বসা।
যা দেয় তাতে সন্তুষ্ট থাকা।
অনুমতি ছাড়া না ওঠা।
বিদায়ের সময় মেজবানের জন্য দোয়া করা।
খাবার শেষে অপ্রয়োজনে বসে না থাকা।
অনুমতি ছাড়া কাউকে সঙ্গে না আনা।
খাবারের দোষ না ধরা।
(তাফসির, সুরা আহজাব: ৫৩; সহিহ বুখারি: ৫৪৩৪; সহিহ মুসলিম: ২০৬৪)
কৃতজ্ঞতা ও দোয়ার শিক্ষা
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি যে কৃতজ্ঞ নয়, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়।’ (আবু দাউদ, আল আদাবুল মুফরাদ: ২১৭) মেহমানদারির প্রতিদান হিসেবে তিনি দোয়া শিখিয়েছেন- ‘হে আল্লাহ! আমাকে যে খাইয়েছে, তুমিও তাকে খাওয়াও; আমাকে যে পান করিয়েছে, তুমিও তাকে পান করাও।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৩৮০৯)
শেষ কথা, ইসলামের মেহমানদারির শিক্ষা হলো সামঞ্জস্য ও ভারসাম্যের। একদিকে মেজবানের জন্য রয়েছে মেহমানকে সম্মান ও আপ্যায়নের নির্দেশ, অন্যদিকে মেহমানের জন্য রয়েছে মেজবানের সামর্থ্য বিবেচনা করে আচরণের শিক্ষা। এই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বিবেচনা সমাজে গড়ে তোলে ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।