শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

দুই জীবনের সফলতার চাবিকাঠি ‘রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা...’

দুই জীবনের সফলতার চাবিকাঠি ‘রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা...’

জীবন কেবল এই দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী যাত্রা নয়; এরপরেও রয়েছে এক অনন্ত গন্তব্য, আখেরাত। একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা তখনই পূর্ণ হয়, যখন সে দুনিয়ায় সম্মান, শান্তি ও সৎ জীবনযাপনের পাশাপাশি আখেরাতেও মুক্তি ও জান্নাতের অধিকারী হয়। ঠিক এই পূর্ণাঙ্গ সফলতার জন্যই আল্লাহ তাআলা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন একটি মহামূল্যবান দোয়া-رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ ‘হে আমাদের রব, আমাদের দুনিয়ায় কল্যাণ দান করুন, আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদের আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা বাকারা: ২০১)


এই সংক্ষিপ্ত অথচ মহামূল্যবান দোয়াটি মুমিন জীবনের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। এতে দুনিয়ার শান্তি ও বরকত যেমন চাওয়া হয়েছে, তেমনি আখেরাতের মুক্তি ও জান্নাতের প্রার্থনাও অন্তর্ভুক্ত। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে সবচেয়ে প্রিয় দোয়াগুলোর অন্যতম ছিল।



দোয়ার গভীর তাৎপর্য

প্রখ্যাত মুফাসসির ইবনে কাসির (রহ.) তাঁর তাফসিরে বলেন, ‘দুনিয়ার হাসানা বলতে বোঝায়- সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, হালাল রিজিক, সৎ জীবন ও কল্যাণকর জ্ঞান ইত্যাদি। আর আখেরাতের হাসানা হলো জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি।’ (তাফসির ইবনে কাসির, আল-বাকারা: ২০১)


এভাবে এই দোয়া মুসলিম জীবনের ভারসাম্যপূর্ণ আদর্শ প্রকাশ করে, যেখানে আধ্যাত্মিকতা, জাগতিক সাফল্য ও নৈতিকতার সমন্বয় ঘটে।


‘হাসানা’: কল্যাণের সমগ্র ধারণা

‘হাসানা’ শব্দটি আরবি ‘হুসন’ মূলধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ সৌন্দর্য, উত্তমতা ও পূর্ণতা। ইসলামি গবেষক ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এই দোয়া মুমিনকে একচোখা জীবনদর্শন থেকে বের করে আনে। এতে শেখানো হয়েছে- শুধু দুনিয়া নয়, শুধু আখেরাতও নয়; বরং উভয়ের ভারসাম্যই প্রকৃত সফলতা।’


দুনিয়ার হাসানা অর্জনের পথ

১. ইবাদত ও আত্মশুদ্ধি: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আল্লাহর শপথ! ইহকাল-পরকালের তুলনা অতটুকুই, যেমন তোমাদের কেউ তার এ আঙ্গুলটি সমুদ্রে পানিতে ভিজিয়ে দেখল যে, কতটুকু পরিমাণ এতে পানি লেগেছে।’ (সহিহ মুসলিম: ২৮৫৮) সালাত ও জিকির মানুষকে মানসিক প্রশান্তি ও শৃঙ্খলাবোধে পরিপূর্ণ করে তোলে।


২. উপকারী জ্ঞান অর্জন: প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ: ২২৪) উপকারী জ্ঞান মানুষকে আলোকিত করে, সমাজে কল্যাণ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে।


৩. হালাল রুজি ও সৎ জীবনযাপন: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘হালাল জীবিকার সন্ধান করা অন্যান্য ফরজের সঙ্গে আরেকটি ফরজ।’ (মেশকাত) হালাল রুজি জীবনে বরকত আনে ও আত্মাকে শান্ত রাখে।


৪. সুস্বাস্থ্য ও পারিবারিক দায়িত্ব: নবী (স.) বলেন, ‘এমন দুটি নেয়ামত আছে, যে দুটোতে অধিকাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তা হচ্ছে- সুস্থতা আর অবসর।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪১২) আরেক হাদিসে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার পরিবারের জন্য সর্বোত্তম।’ (তিরমিজি: ৩৮৯৫)


আখেরাতের হাসানা লাভের উপায়

১. ঈমান ও ফরজ ইবাদত: আল্লাহর একত্ব, নবী-রাসুল, কিতাব, ফেরেশতা, কদর ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এগুলো আখিরাতের সাফল্যের মূল ভিত্তি।


২. সৎকর্ম ও নৈতিক চরিত্র: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম।’ (সহিহ বুখারি: ৬০৩৫) অন্যের উপকার করা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় থেকে বিরত থাকা আখিরাতের হাসানা অর্জনের পথ।


৩. জিকির ও দোয়া: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘জিকিরের মাধ্যমেই হৃদয় প্রশান্ত হয়।’ (সুরা রাদ: ২৮) নিয়মিত দোয়া ও জিকির বান্দাকে আল্লাহর সান্নিধ্যে স্থিত রাখে।


চিরস্থায়ী নেকির সুযোগ

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মানুষ মারা গেলে তার আমল বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত—সদকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান, এবং সৎ সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম: ১৬৩১)


কোরআনের ভারসাম্যমূলক শিক্ষা

আল্লাহ বলেন, ‘আখেরাতের আবাস কামনা করো, তবে দুনিয়া থেকেও তোমার অংশ ভুলে যেও না।’ (সুরা কাসাস: ৭৭) এ আয়াতে দুনিয়া-আখেরাতের ভারসাম্যপূর্ণ জীবনচর্চার নির্দেশনা স্পষ্ট।


মোটকথা, ‘রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা...’ শুধু একটি দোয়া নয়; এটি মুসলিম জীবনের পূর্ণাঙ্গ দর্শন। এতে দুনিয়ার কল্যাণ, আখেরাতের মুক্তি এবং আত্মার শান্তির সমন্বিত শিক্ষা নিহিত। ইসলামি পণ্ডিতদের মতে, এই দোয়া নিয়মিত পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেই সফলতা ও শান্তি দান করেন। নিয়মিত এই দোয়ার আমল তাই কেবল আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেই শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনে না, বরং এটি একটি সুস্থ, ন্যায়নিষ্ঠ ও আল্লাহমুখী সমাজ গঠনেরও অন্যতম হাতিয়ার।

সম্পাদক : অপূর্ব আহমেদ