কুমড়ো ফুলে ফুলে নুয়ে পড়েছে লতাটা, সজনে ডাটায় ভরে গেছে গাছটা, আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি-খোকা তুই কবে আসবি ! কবে ছুটি? কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার বিখ্যাত কবিতা ‘মাগো ওরা বলে’ কবিতায় তার খোকাকে বাড়ি আসতে; প্রলুব্ধ করতে চিঠিতে যে ডালের বড়ির কথা উল্লেখ করেছেন সেটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুমড়ো বড়ি। গ্রাম -বাংলার প্রতিটি বাড়িতে কুমড়ো বড়ি একটি অত্যন্ত প্রিয় এবং সাধারণ খাবার। পাবনার চাটমোহর এলাকার মানুষও দীর্ঘকাল ধরে কুমড়ো বড়ি তৈরি করে আসছে। শীতের তীব্রতায় কুমড়ো বড়ি যেন রসনায় তৃপ্তির নতুন মাত্রা যোগ করে। এটি শুধু গ্রামের গৃহিণীদের সযত্নে তৈরি করা একটি খাবার ছিল না, বরং একসময় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন কৈ, মাগুর, শৈল, জিওল ইত্যাদির সঙ্গে মিশিয়ে রান্না করে পরিবেশন করা হতো। কালের বিবর্তনে বদলে গেছে অনেক কিছু। পূর্বের মতো গ্রাম-বধুরা।
আজকাল কুমড়ো বড়ি শখের বসে তৈরি না করে, বরং এটি হয়ে উঠেছে একটি লাভজনক ব্যবসা। বর্তমানে চাটমোহরসহ বিভিন্ন গ্রাম এলাকায় কুমড়ো বড়ির উৎপাদন বেড়েছে, এমনকি এটি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, দুবাই, সৌদি আরব, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই কুমড়ো বড়ি সংগ্রহ করছেন। এই ব্যবসায় দুই শতাধিক পরিবার জড়িত, যা তাদের জীবিকা নির্বাহে সহায়ক হয়েছে।
চাটমোহর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা যেমন শাহী মসজিদ, দোলং, বোঁথর, মথুরাপুর, বালুচর, রামনগরসহ আরও অনেক গ্রামে কুমড়ো বড়ি উৎপাদন হচ্ছে। এ ছাড়া হান্ডিয়াল, ছাইকোলা, নিমাইচড়া, মূলগ্রাম ইউনিয়নেও এই পণ্যটি তৈরি হচ্ছে। কুমড়ো বড়ি তৈরি মূলত নারীরাই করেন। পুরুষরা সাধারণত বাজারজাতকরণে সহায়তা করে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা মৌসুমি আয়ের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
ব্যবসার দিক—
প্রতিটি কুমড়োর বড়ির মূল্য বিভিন্ন উপকরণের ওপর নির্ভর করে। আকার অনুযায়ী চাল কুমড়ো ৪০ থেকে ৫০ টাকা দরে কিনতে হয়, আর ডাল কিনতে হয় ৮৫-৯০ টাকা কেজি দরে। প্রতিটি কেজি ডাল থেকে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম বড়ি তৈরি হয়। বাজারে এই বড়ি ১৪০-১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। তবে, শিল-পাটায় বাটা ডালের বড়ির চাহিদা কিছুটা বেশি, কারণ এর স্বাদে ভিন্নতা থাকে।
চাটমোহরের উৎপাদিত কুমড়ো বড়ি এখন ঢাকা, চট্টগ্রামের কাঁচাবাজারগুলোতেও পৌঁছে গেছে। পাইকাররা নানা জেলা থেকে কুমড়ো বড়ি কিনতে আসে চাটমোহরে।
উৎপাদন ও পুষ্টি—
একজন সাধারণ ব্যক্তি প্রতিদিন ২০ কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে সক্ষম। নারীরা তাদের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকে এই কাজ সম্পন্ন করে। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত এই ব্যবসা খুবই লাভজনক হয়। এই মৌসুমে অনেক পরিবার তাদের অতিরিক্ত আয় দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন করছে। কুমড়ো বড়ি শুধু ব্যবসার জন্য নয়, এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশও।
স্থানীয়রা জানান, কুমড়ো বড়ি তৈরির সময় এর সঙ্গে মিঠাপানির মাছের সংযোগ হলে খাবারের স্বাদ আরো বৃদ্ধি পায়। চলনবিল অঞ্চলের মিঠাপানির দেশি মাছ যেমন কৈ, মাগুর, শিং, শৈল, আইড় ইত্যাদির সঙ্গে কুমড়ো বড়ি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
পুষ্টিবিদ কুমকুম ইয়াসমিন জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম মাষকলাইতে রয়েছে ৩৪১ মিলিগ্রাম ক্যালরি, ৯৮৩ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, ২৫ গ্রাম প্রোটিন, ৩৮ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ১৩৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, এবং ৭.৫৭ মিলিগ্রাম আয়রন। এ ছাড়া চাল কুমড়া অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি সবজি। এটি বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, মিনারেল এবং ফাইবারে সমৃদ্ধ। চাল কুমড়া কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস্ট্রিক এবং যক্ষ্মা রোগের উপশমে সহায়তা করে। কুমড়ো বড়ি শুধু স্বাদে নয়, পুষ্টিতে ভরপুর একটি খাবার।
বিশেষ প্রতিনিধি | বাংলাবাজার পত্রিকা.কম
























